
নোয়াখালীর হাতিয়ার জাগলার চর দখলকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষ ও গোলাগুলিতে পাঁচজন নিহত হওয়ার ঘটনায় চরের নিয়ন্ত্রণে থাকা তিনটি সন্ত্রাসী বাহিনীর তথ্য উঠে এসেছে। স্থানীয় বাসিন্দাদের ভাষ্য অনুযায়ী, ‘কোপা শামছু বাহিনী’, ‘আলাউদ্দিন বাহিনী’ ও ‘ফরিদ কমান্ডারের বাহিনী’ দীর্ঘদিন ধরে চরটির জমি দখল করে কম দামে বিক্রি করে আসছিল। গতকাল মঙ্গলবার এই দখল নিয়েই ভয়াবহ সংঘর্ষ ও গোলাগুলির ঘটনা ঘটে।
সন্ত্রাসী বাহিনীগুলোর সদস্যদের কোনো নির্দিষ্ট রাজনৈতিক পরিচয় না থাকলেও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের আশ্রয়ে তারা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড চালিয়ে আসছে বলে অভিযোগ করেছেন স্থানীয়রা।
গতকাল সকালে হাতিয়া উপজেলার সুখচর ইউনিয়নের ৭ ও ৮ নম্বর ওয়ার্ডসংলগ্ন জাগলার চরে জমি দখলকে কেন্দ্র করে তিন বাহিনীর মধ্যে ত্রিমুখী সংঘর্ষ শুরু হয়। একপর্যায়ে ফরিদ কমান্ডারের বাহিনী পিছু হটে গেলে কোপা শামছু ও আলাউদ্দিন বাহিনীর মধ্যে গোলাগুলি হয়।
বন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, প্রায় ২৫ থেকে ৩০ বছর আগে মেঘনা নদীর বুকে জেগে ওঠা এই চরে এখনো কোনো স্থায়ী বসতি নেই। তবে প্রতিদিন গড়ে দুই থেকে তিন শ মানুষ পশুপালন ও চাষাবাদের জন্য এখানে যাতায়াত করেন। চরটির কোনো জমিই সরকারিভাবে কাউকে বন্দোবস্ত দেওয়া হয়নি।
আজ সকালে চরটিতে গিয়ে দেখা যায়, হাতে গোনা কয়েকজন মানুষ গরু-মহিষ চরানো ও কৃষিকাজে ব্যস্ত। তবে গতকালের সংঘর্ষ নিয়ে কেউই সুনির্দিষ্ট তথ্য দিতে পারেননি।
স্থানীয়দের ভাষ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর থেকে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে চরের জমি দখল শুরু হয়। প্রথমে কোপা শামছু বাহিনী জমি দখল করে প্রতি একর ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকায় বিক্রি শুরু করে। পরে আলাউদ্দিন বাহিনী একইভাবে জমি বিক্রিতে জড়ায়। কয়েক মাস আগে ফরিদ কমান্ডারের বাহিনী যুক্ত হলে তিন পক্ষের মধ্যে বিরোধ ও সংঘর্ষ তীব্র আকার ধারণ করে। এর আগে গত ১৬ ডিসেম্বর জমি দখলের প্রতিবাদ করায় জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) তিন কর্মী হামলার শিকার হন।
গতকালের সংঘর্ষে আলাউদ্দিন বাহিনীর প্রধান আলাউদ্দিন গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। পরে পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে আরও চারজনের লাশ উদ্ধার করে। নিহতরা হলেন মোবারক হোসেন, আবুল কাশেম, হক মিয়া ও কামাল উদ্দিন।
বাসিন্দারা জানান, আগে এসব বাহিনীর সদস্যরা নিজেদের আওয়ামী লীগের লোক পরিচয় দিতেন। ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর কেউ বিএনপি, কেউ জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) পরিচয় দিয়ে এলাকায় প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছেন।
এনসিপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক ও নোয়াখালী-৬ আসনের প্রার্থী আবদুল হান্নান মাসউদ অভিযোগ করেন, নির্বাচনকে সামনে রেখে বিএনপি এসব সন্ত্রাসী বাহিনীকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিচ্ছে। তিনি বলেন, প্রশাসনকে বারবার ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানালেও কার্যকর পদক্ষেপ না নেওয়ায় এই প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে।
তবে বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ও একই আসনের প্রার্থী মাহবুবের রহমান অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, সন্ত্রাসীদের কোনো রাজনৈতিক পরিচয় নেই, তারা অপরাধী। প্রশাসনের সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানান তিনি।
মামলা হয়নি, আটকও নেই
সংঘর্ষ ও গোলাগুলিতে পাঁচজন নিহত হওয়ার ঘটনায় আজ বুধবার দুপুর পর্যন্ত কোনো মামলা হয়নি এবং কাউকে আটকও করতে পারেনি পুলিশ। নিহতদের লাশ ময়নাতদন্তের জন্য নোয়াখালী জেনারেল হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়েছে।
হাতিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আলা উদ্দিন জানান, আরও একজন নিহত হওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে এবং তাঁর লাশ উদ্ধারে নৌবাহিনী অভিযান চালাচ্ছে। তিনি বলেন, নতুন জেগে ওঠা এই চরে সরকারিভাবে কাউকে জমি বন্দোবস্ত দেওয়া হয়নি।
হাতিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. সাইফুল আলম বলেন, অভিযোগ পেলে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বন বিভাগের নলচিরা রেঞ্জ কর্মকর্তা আল আমিন গাজী জানান, চরটিতে প্রায় এক হাজার হেক্টর জমিতে বনায়ন করা হয়েছে, তবে বর্তমানে চরের মোট আয়তন সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই।